শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০০৯

জেনের ভিতর দিয়ে

বলা হয়, মৌনতা বা নীরবতাই জেন। কিন্তু জেনগল্প সম্পর্কে লিখতে বসে মৌন হয়ে বসে থাকা যথেষ্ট নয় বলেই জেনরিক্ত-বাচালতাটুকু সম্মানিত পাঠকের ওপর চাপিয়ে দিতে হচ্ছে, তাতে সটোরি লাভ সহজতর হবে এমন যদিও বলা যাচ্ছে না একেবারেই। তবে জেন কুলাচারকে অল্পবিস্তর ছুঁয়ে আসা গেলে সম্মানিত পাঠকগণ জেনের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময়টুকুতে রৌদ্রযোগ পেলেও পেতে পারেন। এই যা!

কথাগুলো এখান থেকে শুরু করা যায় যে, জেন হলো মহাযানী বৌদ্ধবাদের একটি বিশেষ ঘরানা, যেটি ঘোষণা করে যে বোধিলাভের জন্য বিশ্বাস ও ভক্তির প্রয়োজন অনস্বীকার্য নয়, বরং অনস্বীকার্য ধ্যান, আত্মঅবলোকন ও স্বজ্ঞার উপস্থিতি। চীনে এটি বৌদ্ধবাদ ও তাওবাদের একটা ফিউশন, জাপানে ফিউশন বৌদ্ধবাদ ও সূর্যপূজক শিন্টুর ; যার আদিমূল নিহিত সংস্কৃত ধ্যান শব্দের মধ্যে। এটি বিভিন্ন নামে চর্চিত হয় প্রধানত চীন (চান), জাপান (জেন), কোরিয়া (সিওন) ও ভিয়েতনাম (থিয়েন)-এ।

প্রতিদিনের ব্যবহারিক যাপনই জেন। একটি শান্ত, আত্মবিশ্বাসী, নির্ভরযোগ্য সত্তাই জেনের সত্য। এ মত ঈশ্বরান্বেষণে সময় ক্ষেপণ করে না, বরং প্রতিক্ষণের যাপন থেকে জীবনসত্য আহরণ করে। যাপনসঞ্জাত এই জ্ঞানই জেনবাদীদের পাথেয়। এটি সরাসরি জীবনে অবদান রাখে, তবে তা আত্মা বা ঈশ্বরের নামে উপস্থিত হয় না। জেন কাজ করে দিনকার স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়াকে কোনোভাবে ব্যাহত বা বিঘ্নিত না-করে। জেনের চাওয়া জীবনের প্রবাহকে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে পারা বা এর পরম্পরাকে ছুঁতে পারা। জেনে অস্বাভাবিক বা গুপ্ত কিছুর অস্তিত্ব নেই। জেন ক্ষুধা লাগলে খাওয়া আর ক্লান্তি লাগলে ঘুমানোর কথা বলে। বলে যে, পড়ার সময় পড়ো, হাঁটার সময় হাঁটো, খাওয়ার সময় খাও, ঘুমানোর সময় ঘুমাও-- শর্ত কেবল একটিই, যাই করো মন দিয়ে মগ্ন হয়ে করো। আমি পড়ছি ও লিখছি, দ্য হিলিং ফরেস্ট শুনছি, বোতলের মুখ খুলে জল পান করছি, একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছি, সাইবার জগতের দরজা পেরিয়ে ২০০০ বছর অতীতের কোনো অনুশাসন ঘাঁটছি-- এর সবই জেনচর্চা, অর্থাৎ আমি ধ্যানের ও প্রকারান্তরে জেনের মধ্যেই আছি। এর শাব্দিক আলোচনা বা ব্যাখ্যা একদম দরকার নেই, এ স্বতঃউপলব্ধ। যখন সূর্য ওঠে, সারা পৃথিবীই তখন আনন্দে নাচতে থাকে এবং প্রত্যেকের অন্তঃকরণ পূর্ণ হয়ে ওঠে তৃপ্তিতে। এর আবার ব্যাখ্যা কী! জেন গুরুত্ব দেয় ‘এখানে এখন’কে। জেন অতএব এ মুহূর্তে এখানেও আছে।

জেনকে বোঝা কঠিন, এর মানে এটা বোঝা যে এটা বোঝার জন্য নয় ; জেনকে বোঝা সহজ, এর মানে এটা না-বোঝাই হলো এটাকে বোঝা। একবার এক জেনগুরু বিবৃত করেছিলেন যে, ‘এমনকি শাক্যমুনি বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়ও এটা বোঝেন নি, একজন সাধারণ-মনের দুর্বত্ত কী করে একে বুঝবে ?’ এক জাপানি শিক্ষক জেনবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ‘জীবনের পথ’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন। এক চীনা চানগুরু একটি বিখ্যাত উক্তি রেখে গিয়েছিলেন, যেটি ছিল তাঁর নিজের জীবনের পথপ্রদর্শক নীতি, সেটি হলো, ‘কাজ নেই তো খাবারও নেই।’

জেন তত্ত্বীয় জ্ঞানচর্চা ও ধর্মীয় পুস্তক পাঠকে নিরুৎসাহিত করে এবং গুরুত্ব আরোপ করে অনুশীলন ও পরীক্ষামূলক প্রজ্ঞায়। জেনবাদীরা আত্মউন্মেষ ঘটিয়ে আপনার সন্ধান লাভে তৎপর, ধ্যান যে ঠিকানায় পৌঁছবার তোরণ। জেনার্থীরা অভিজ্ঞতার ওপরেই বেশি জোর দেয়, প্রতিক্ষণের জীবনযাপনকে মূল্যায়ন করে, যা নাকি জীবনের মূলসত্যের দিকেই যাওয়া।

অধিকাংশ মানুষ যেখানে মনোসংযোগ করে মুদ্রিত শব্দ ও বাক্যে, জেন সেখানে তাকাতে বলে অন্তরে। জেন ভালোবাসে জীবনের প্রান্তিকতা, শূন্যস্থান। জেনচর্চা নিজেকে সারাক্ষণ শূন্য ও অজ্ঞ ভাববার শিক্ষা। জেনবাদ কখনোই জ্ঞানপূর্ণ পাত্র নয়, বরং অর্ধেক খালি পাত্র। প্রতিমুহূর্তের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে জেনবাদীরা সে শূন্যতা ঘুচাতে তৎপর। তাও মাস্টার লাও জি (৬ষ্ঠ শতাব্দী) একবার বলেছিলেন যে, ‘একটি ভবনের সবচেয়ে মূল্যবান স্থান কেবল দেয়াল ও ছাদ নয় যা বাস্তুনির্মাতা অনেক যত্নে নির্মাণ করেন, মূল্যবান ওর পাশের শূন্য স্থানটুকুও।’ জেনের মেজাজটি ধরা পড়ে এই রাশিয়ান প্রবাদেও যে, “সে কোনো মুক্ত মানুষই নয়, যে কখনো ‘কিছুই না’ করে না।”

উল্লেখ্য যে, জেন গৌতম বুদ্ধের মূল শিক্ষাকে অস্বীকার করে না, একই নির্বাণে পৌঁছবার জন্য বিশিষ্ট উপায় ব্যবহার করে মাত্র। মহাযানী বৌদ্ধদর্শন শূন্যবাদের প্রবক্তা নাগার্জুন বুদ্ধের উপদেশ ব্যাখ্যাকালে একবার বলেছিলেন, নির্বাণাবস্থায় উচ্চস্তরের পরমার্থ-সত্য বা পূর্ণ-সত্য উপলব্ধ হয়। নির্বাণ কীরকম তা কোনোপ্রকার ইন্দ্রিয় প্রত্যয়ের দ্বারা অবর্ণনীয়। তা অনির্বচনীয়, বাক্য ও মনের অগোচর। তা এ নয়, ও নয়, তার উৎপত্তি নেই, বিনাশ নেই ইত্যাদি নেতিমূলক বচনের দ্বারা নির্বাণের কথঞ্চিৎ আভাস দেওয়া যায়। নির্বাণের এই সংজ্ঞা জেনবাদীদের অভীষ্ট সটোরির প্রায় সমার্থক।

জেনের প্রবর্তক বোধিধর্ম (সম্ভবত ৪৪০-সম্ভবত ৫২৮), যিনি ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় পল্লভা রাজকুমার। পরে তিনি ভিক্ষুত্ব বরণ করেছিলেন। জানা যায়, ৫২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চীনে যান। চীনে তখন মহাযানী বৌদ্ধবাদ রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত। মহাযান ভক্তিবাদী। মহাযানে বুদ্ধ ঈশ্বর আর শাক্যমুনি তার অবতার। জনসাধারণের মধ্যে বৌদ্ধধর্মকে প্রসারিত করবার জন্য এমনকি মহাযানে বৌদ্ধপূজা ও বোধিসত্ত্বপূজাও প্রবর্তিত হয়। বোধিধর্ম দেখতে পান এসবের ভিতর দিয়ে মহাযানী মতাবলম্বীরা অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের লক্ষ্য বর্জিত হয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভজনকৃত্যে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। আত্মার স্পর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে নানা আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত থাকাতেই তারা বেশি মনোযোগী। দেখলেন, ধ্যানের চেয়ে পূজার্চনা ও পবিত্র স্তোত্রপাঠে তারা বেশি আগ্রহী। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাবাহিত অন্তর্দৃষ্টির সরাসরি উদ্বোধনে মনোনিবেশ করেন।

সপ্তম শতাব্দীতে জেন বৌদ্ধবাদের আলাদা একটি ঘরানা হিসেবে সমাদৃত হয়। জেনচিন্তা বিকশিত হয় মহাযানী বৌদ্ধবাদের বিভিন্ন ধরন যেমন যোগাচারমধ্যমাখা দর্শন, প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্র এবং স্থানীয় চৈনিক ঐতিহ্য বিশেষ করে হোয়াইয়ান বৌদ্ধবাদ এবং লাও-ৎ-স প্রবর্তিত তাওবাদের মিশ্রণে। চীন থেকে এর চর্চা পরে ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণমুখে ভিয়েতনাম এবং পূর্বমুখে কোরিয়া ও জাপানে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশ ও বিংশ শতাব্দীর সূচনাংশে এটি উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অনুসারী খুঁজে পায়।

চীন ও জাপানের অনেক লোককথা বা পুরাকথায় জেনকথাও মিলেমিশে আছে। এরকম একটি হলো বিনা শব্দবাক্যের পুষ্প অভিভাষণ। জেন বৌদ্ধবাদের সূচনাবিন্দু ধরা হয় এই ‘পুষ্প অভিভাষণ’কে। কথিত আছে যে, একদিন শাক্যমুনি বুদ্ধ তার অনুসারীদের সাথে এক ধর্মদেশনা বৈঠকে মিলিত হন। অনুসারীরা সবাই সমবেত হলেও শাক্যমুনি ছিলেন পুরোপুরি নীরব। এক্ষেত্রে কিছু দূরকল্পনা করা হয় যে তিনি হয়ত ক্লান্ত বা অসুস্থ ছিলেন। যাহোক, মুনি নীরবে হাতে একটা পদ্মফুল নিয়ে তা উঁচিয়ে ধরেন। তার কতিপয় অগ্রসর অনুসারী বিবৃত করবার চেষ্টা করেন যে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, কিন্তু তাদের কেউই সঠিক ছিলেন না। একজন শিষ্য, মহাকাশ্যপ, ফুলটি দেখে কেবল নীরবে হাসেন। জানান যে, শব্দবাক্য ব্যতীত ওটা ছিল সরাসরি বুদ্ধের অন্তকরণ থেকে উঠে আসা বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি। মহাকাশ্যপ কোনোভাবে ফুল-উত্তোলনকৃত্যে নিহিত মানেটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। শাক্যমুনি মহাকাশ্যপের ওই অন্তর্দৃষ্টিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ‘দৈববাণীহীন বিশেষ সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে আমি জ্ঞাপন করেছি সত্য ধর্মচক্ষু, নির্বাণের বিস্ময়কর চিত্ত, আকারহীনের সত্য আকার, নিগূঢ় ধর্ম দরজা ; শব্দ ও বর্ণ যা ধরতে পারে না ; যা আমি বিশ্বাসভরে মহাকাশ্যপকে অর্পণ করেছি।’

প্রাচ্য দর্শনের সারবস্তুটুকু জেন-এ নিহিত আছে বটে, কিন্তু জেন নিজে কোনো দর্শন নয়, অন্তত যে অর্থে শব্দটি সচরাচর ব্যবহৃত হয়। এটি যুক্তি চালাচালি বা বিশ্লেষণেরও কোনো পদ্ধতি নয়। যদি বলতেই চাওয়া হয় তো বলতে হবে এটি যুক্তির ঠিক উলটো ব্যাপার। যুক্তি ভেঙে (খণ্ডন করে নয়) তার ওপরে অযুক্তিজাত সত্য উপলব্ধির চিত্তশামিয়ানা খাটানো।

ধর্ম বলতে লোকজন প্রধানত যা বোঝে জেন তাও নয়। জেন-এ পূজার জন্য কোনো দেবতা নেই। উদযাপনের জন্য কোনো ধর্মীয় উৎসব নেই, মৃতের গন্তব্যাবাসকে নিষ্কণ্টক করবার জন্য কোনো পরিচর্যা নেই, কল্যাণ প্রার্থনার জন্য কোনো চিরজীবী আত্মা নেই। জেনচর্চাকারীর কাঁধে এরকম কোনো বিশ্বাসভার অর্পিত হয় নি। এর মানে এ নয় যে জেন বলে কোনো ঈশ্বর নেই, আবার জেন এও বলে না যে ঈশ্বর আছে। জেন এটা খারিজও করে না, নিশ্চিতও করে না। জেন এমন উচ্চাঙ্গের সত্যতায় পৌঁছুতে চায়, যার কোনো পালটা মতবাদ কোথাও থাকতে পারে না। তবে এটি স্বীকার করা ভালো যে, জেনে ধর্ম ও দর্শন উভয়েরই কিছু ছোপছাপ দ্রষ্টব্য হয়ে আছে। অংশত এটি দর্শন, অংশত ধর্ম ; এবং অংশত এটি দর্শন ও ধর্ম উভয়কেই খারিজ করে দেয়।

বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে শিক্ষা দেবার কিছুই নেই জেন-এ। এতে এমন কোনো নীতিশিক্ষা নেই, যা তার অনুসারীদের পালনে বাধ্য করা হয়। এ বিবেচনায় বলা যায় যে, এটি যথেষ্ট বিশৃঙ্খল মতবাদ, তবে অবশ্যই তা নৈরাজ্যকর নয়। জেন অনুসারীদের পালনীয় কিছু রীতিনীতি আছে, তবে তা কেবল তাদের নিজেদের জন্য। জেন-এ কোনো পবিত্র গ্রন্থ নেই, নেই কোনো প্রতীকী সূত্র, যে পথে কেউ জেনের বিশিষ্টতা অর্জন করে উঠবেন। জেন কিছুই শেখায় না। জেন-এ যা কিছু শিক্ষা তা আসে ব্যক্তির নিজের মন থেকে, যা নির্গত হয় গুরুর মধ্যস্থতায় স্বশিক্ষা সূত্রে। জেন এ পথটিই মাত্র সুনির্দিষ্ট করে দেয়।

যখন বলা হয় যে জেন কোনো ধর্ম বা দর্শন নয়, তখন বোঝানো হয় যে, এটি কর্তৃত্বপরায়ণ সব রীতিনির্দেশকে উপেক্ষা করে এবং তথাকথিত সব ঐশী বাক্যকে রাবিশ জ্ঞান করে। কিন্তু এটি প্রণিধানযোগ্য যে, এ ধরনের না-সূচক পরিচয় ধারণ করেও জেন কিছুক্ষেত্রে অন্তর্গতভাবে হাঁ-সূচক। অর্থাৎ জেন পুরোপুরি নেতিবাচক নয়, এটি শুধু অতিরিক্ত ভারটুকু ঝেড়ে ফেলতে চায়।

আগেই বলা হয়েছে যে, সংস্কৃত ধ্যান থেকে এসেছে জেন এবং জেনে ধ্যান ওতপ্রোত। কিন্তু জেন ধ্যানসর্বস্ব নয়। একজন ধর্মীয় কারণে, দার্শনিক ও শৈল্পিক প্রয়োজনে ধ্যানস্থ হতে পারেন। সেটি হতে পারে দৈবাৎ। কিন্তু জেন হলো এক নিয়মানুবর্তিতা, মনের। যা হয় ক্রমাগত চর্চার মাধ্যমে মনের আসল প্রকৃতি জাগ্রত করার ভিতর দিয়ে স্বোপার্জিত। এই নিয়মানুবর্তিতা মনের চক্ষু খুলে দেয়, যা খুঁজে পেতে চায় অস্তিত্বের প্রকৃত কারণ। তাই বলা যায়, মনই জেনের মুখ্য চর্চার ক্ষেত্র।

বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জেন ব্যাখ্যা করতে চাওয়া নিশ্চিতভাবে একটি বিফল উদ্যোগ, কারণ এ পথে এর বয়ান অসম্ভব। দার্শনিকোচিত কোনো মূল্যায়ন জেনের প্রতি মোটেই সুবিচার নয়। জেন মাধ্যমকে ঘৃণাভরে উপেক্ষা করে, এমনকি তা যদি হয় বুদ্ধিবৃত্তিক মাধ্যমও। এটি প্রধানত এবং চূড়ান্তভাবে নিয়মানুবর্তিতা ও অভিজ্ঞতার সমাহার, যা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। জেনকে ব্যাখ্যার চেষ্টা তাই প্রায়শই শ্রম ও সময়ের অপচয় শুধু। এতে বিষয় থেকে বিষয়ের বাইরে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই কেবল প্রকট হয়, অথবা সবটা মিলে একটা তালগোলে পরিণত হয়।

জেন সর্বজনীন। এটি আস্তিকেরও, আবার নাস্তিকেরও। অন্য ধর্মাবলম্বী একজন চাইলেও জেনচর্চা করতে পারেন, এজন্য ধর্মচ্যুত হবার দরকার নেই। জেনে সমানভাবে সবার প্রবেশাধিকার সৃষ্টি হবার অবকাশ আছে। এই কোয়ানটি তার একটি ইঙ্গিত বহন করে।
জোশু একবার এক নবাগত ভিক্ষুকে প্রশ্ন করলেন,
‘তুমি কি পূর্বে কখনো এখানে ছিলে ?’
ভিক্ষু বলল, ‘জী হ্যাঁ, ছিলাম’।
অবিলম্বে জোশু বললেন, ‘চা খাও’।
পরে অন্য এক ভিক্ষু এলে জোশু তাকেও একই প্রশ্ন করলেন,
‘তুমি কি পূর্বে কখনো এখানে ছিলে ?’
এবারে জবাব ঠিক উলটো, ‘আমি কখনো এখানে ছিলাম না’।
বৃদ্ধ জোশু, তৎসত্ত্বেও, একই উত্তর করলেন, ‘চা খাও’।
মঠের ব্যবস্থাপনাধ্যক্ষ ইনজু জোশুকে বললেন, ‘এটা কী ধরনের ব্যাপার যে ভিক্ষুরা কী জবাব দিচ্ছে না-দিচ্ছে তার কোনো ধার না-ধেরে আপনি সবাইকে একইভাবে চা সাধছেন ?’
বৃদ্ধ জোশু হাঁক দিলেন, ‘হেই ইনজু!’, তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, ‘জী মাস্টার’।
‘চা খাও’, জোসু বললেন।
সবাইকে প্রবেশাধিকার দিলেও জেনের কোনো জাত যায় না। সবার জন্য এর সমান বিবেচনা। সবারই এক কাজ, এক মাহিনা। কারো প্রতি বৈষম্যে তার কোনো মতি হয় না।
চাও-চৌকে একবার এক ভিক্ষু জিজ্ঞেস করেন, 'একটি কুকুরের কি বৌদ্ধ স্বভাব আছে ?' চাও-চৌ বললেন, 'বাদ দিয়ে'।
প্রথমত এ প্রশ্নের জবাব বোধগম্য। বৌদ্ধচিন্তার একটি নীতি হলো এই বিশ্বাস যে প্রত্যেক চেতনপ্রাণীর বুদ্ধস্বভাব আছে। এ দৃষ্টিতে কুকুর চেতনপ্রাণী, অতএব তার বুদ্ধস্বভাব আছে। কাজেই ভিক্ষু এখানে ওই বোধগম্য জবাবটি আশা করছেন না। প্রশ্নটিও এখানে তত্ত্বীয় নয়, প্রত্যাশিত জবাবটিও নয় আক্ষরিক। জেনাগ্রহীর সাথে তার শিক্ষাগুরুর মধ্যকার এরকম ধাঁধাময় কথোপকথনই কোয়ানকে সংবিধিত করে।

কোয়ান হলো ধ্যানকেন্দ্রে একজন শিক্ষক ও একজন শিক্ষার্থীর মধ্যকার কূটাভাষপূর্ণ ও ভাষাতাত্ত্বিকভাবে অর্থহীন প্রশ্নোত্তর বা সংলাপ, উপবেশিত ধ্যান বা জাজেনকালে যা জেনার্থীদের কাজে লাগে তত্ত্বীয় ধারণা ও যুক্তিশৃঙ্খলাকে ভেঙে দিতে। হণ্টনধ্যান এবং দৈনন্দিন সকল কর্মযোগেও কোয়ান ব্যবহারের ঐতিহ্য রয়েছে। বলা যায়, কোয়ান হলো পদ্ধতিগত ধ্যানের একটি অবশ্য উপকরণ। কোয়ানে যে ধরনের প্রশ্ন বা সমস্যা উত্থাপিত হয় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ জবাব তার ক্ষেত্রে খুব ভোঁতা, ভোঁতা জবাব উত্তরপ্রার্থীকে শাণিত করতে পারে না। ধ্যানার্থীর দরকার তীব্র, অব্যর্থ ও প্রভাবসঞ্চারী জবাব, যা ইন্ধনসক্ষম। অনেক কথা বলবার তাদের সময় নেই, তত্ত্বীয়ভাবে বুঝিয়ে দেয়াও অভীষ্ট নয়। আন্তর-বাস্তব ছুঁয়ে দেখার জন্য মন জাগানোই সেখানে উদ্দীষ্ট। তাছাড়া ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’সূচক জবাব এখানে সত্য প্রকাশেও ব্যর্থ। সৃজনশীল শিল্পকর্মের মতো তখন প্রয়োজন হয়ে পড়ছে উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগের। জন্ম নিচ্ছে প্রাকৃতিক ও স্বতঃস্ফূর্ত জবাব। জন্ম হচ্ছে ধাঁধার, কূটাভাষের, কোয়ানের।

প্রতিটি কোয়ানকে এক একটি করে পাবলিক কেস ধরা হয়, জেনচর্চার। পরিচিত ও বিখ্যাত কোয়ানগুলো দশম শতাব্দী পর্যন্ত ৫২টি প্রজন্মের বিশিষ্ট জেনব্যক্তিত্বের সঙ্গে তদানুসারীদের সংলাপ ও তদ্বারা ব্যবহৃত। তবে থেমে নেই কোয়ানের জন্ম, এখনো মঠে মঠে জেনআচার্যেরা জন্ম দিয়ে চলেছেন এই শিক্ষা উপকরণ।

কোয়ান বা কো-আন এসেছে চীনা শব্দ কাঙ-এন থেকে, যার আক্ষরিক মানে ‘গণবার্তা’, বা ‘গণঘোষণা’। সর্বমোট ১৭০০ কোয়ানের কথা জানা যায়। তবে এগুলোর মধ্যে ব্যবহারিক কাজে লাগে মাত্র ৬০০ থেকে ৭০০টি। বাকিগুলোর হয় ব্যবহারোপযোগিতা নেই, নতুবা পুনরাবৃত্তিতে ঠাসা। এ যাবৎ ব্যবহারোপযোগী কোয়ানগুলোই বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। মূল চীনা ও জাপানি ভাষা থেকে এগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে। কোয়ানের প্রথম সংগ্রহটি হলো ব্লু ক্লিফ রেকর্ড। মোটমাট ১০০ কোয়ানের এ গ্রন্থনাটি প্রথমে করেন ১১২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রেইস্ট সোয়েহ-টও নামে জে. সেটচু জুকেন। দ্বিতীয়টি দি গেটলেস গেট, মাত্র ৪৮টি কোয়ানের গ্রন্থন। এটি হয় ১২২৮ সালে চীনা পুরোহিত উওমেন হুইকাই (১১৮৩-১২৬০)-এর হাতে। গ্রন্থিত হওয়ার আগে হাজার বছর ধরে এসব টেক্সট টিকে ছিল মৌখিক ঐতিহ্য হিসেবে। অগ্রন্থিতগুলো এখনো সেভাবেই টিকে আছে।

শান্ত অথচ তীর্যক কথোপকথন, অনেকার্থকতা, বিরোধার্থক অভিব্যঞ্জনা এবং অসম্পূর্ণ সম্পূর্ণতাই এসব কোয়ানকে গল্প বলার সাহস জোগায়। এগুলো কেননা কমবেশি গল্পেরও বৈশিষ্ট্য। একজন যিনি জেনচর্চা করেন না, ধ্যানক্ষেত্রের ব্যবহারিক প্রয়োগের সার্থকতা যার কাছে কোনো মানে বহন করে না, তার কাছে এগুলো স্রেফ গল্পকথা। সমস্যা কী ? এ গল্প তো একজন পাঠককে বিষয়নিমগ্ন করে তুলতে পারে, চিন্তাকে উসকে দিয়ে ফের ঝুরঝুর করে ঝরিয়ে দিয়ে পারে মনকে জাগিয়ে দিতেও।

জেন ঐতিহ্য অনুযায়ী সটোরি হচ্ছে আলোকদীপ্তির জাপানি প্রতিশব্দ, যার আক্ষরিক মানে উপলব্ধি বা অন্তর্দৃষ্টি খুলে যাওয়া, কখনো বা সহসা জাগরণ বা আকস্মিক চৈতন্যোদয়। এটি ব্যক্তির সম্যক সম্বোধি, কখনোই দলগতভাবে অর্জিত হয় না। সটোরি ব্যক্তির স্বজ্ঞাপ্রসূত অভিজ্ঞতা।

জেন যদি ভ্রমণপথ তো সটোরি তার উদ্দীষ্ট। জেনের মূল লক্ষ্য ব্র‏হ্মাণ্ডকে নতুন ও পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা, অর্থাৎ সটোরি লাভ করা। এ পর্যায়ের জানাবোঝা, ব্র‏হ্মাণ্ডের অসীমতাকে উপলব্ধি করা ও তার মাধ্যমে প্রশান্তি লাভই জেনার্থীর অভীষ্ট। ডি. তেইতারু সুজুকি (১৮৭০-১৯৬৬)-এর মতে, ‘সটোরি হচ্ছে জেনের হয়ে ওঠার কারণ। এটি ছাড়া জেন কোনো জেন নয়।’

পরিপূর্ণ অবস্থার বৃহত্তর প্রতীতী যখন মাহূর্তিক, তখন সে অভিজ্ঞতা হলো কেনশো। ক্ষীণালোকমণ্ডিত ব্র‏হ্মাণ্ড সম্পর্কিত এই মাহূর্তিক উপলব্ধি আলোকদীপ্তি নয়, তবে সেদিকেই অগ্রসর হওয়া। একজনকে অবশ্যই এই অভিজ্ঞতা নির্মাণ করতে হয় পুনঃপুনঃ চর্চার ভিতর দিয়ে। এই অর্জন কেবল টেকসই দৃষ্টিশৈলী অর্জনের জন্য নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টি লাভের যথাযথ পন্থা খুঁজে পাবার জন্যও। একটি ছোট্ট শিশু কয়েক পা হেঁটে পড়ে গেল, এটি কেনশো ; কিন্তু শেষপর্যন্ত সে উঠে দাঁড়াতে শিখল ও না-পড়ে হাঁটতে লাগল, এটি সটোরি। আলোকদীপ্তির অনুভব সকল জীবের বন্ধনহীনতার উপলব্ধি। এটা প্রাকৃতিক সমন্বয় ও ব্রহ্মাণ্ডের সৌন্দর্যের মধ্যে শান্তি ও স্বস্তির অনুভব।

সকালে হয়ত ঘুম থেকে জেগেছি ধরা যাচ্ছে কী যাচ্ছে না ধরনের একটি বিষয়কে মাথায় নিয়ে। ওই অবস্থায় দৌড়ের ওপরে যাবতীয় প্রাতকৃত্য সম্পন্ন করে কর্মস্থলাভিমুখে তাড়া করছি। রিক্সায় বসেও বিষয়টা মাথায় খেলছে। আশপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে দেখছি না, শুনছি না। আসলে সেদিকে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে না। অফিসে গিয়ে একগাদা কাজের মধ্যে ডুবে গেলেও থেকে থেকে খেলছে হয়ত বিষয়টা। কিন্তু বাগে আসছে না, অথবা এসেছে কি না তা পরখ করে দেখাই হচ্ছে না। অফিস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকছি, তাও ফাঁকে ফাঁকে হয়ত উঁকি দিচ্ছে একটা-দুইটা লাইন। রাতে বাসায় ফিরেও নানা গার্হস্থ্যঘোর, মাথা ভারী। সবদিক ঠাণ্ডা হয়ে এলে এবার হয়ত মনোসংযোগ করা গেল। লাইনটাক লিখে ধ্যানস্থ হয়ে আছি। সময় যাচ্ছে, কিন্তু ধরা যাচ্ছে না ওই অধরাকে। সহসাই হয়ত উত্তীর্ণ হওয়া গেল কেনশোতে, মন জাগল, সরসর করে নেমে এল বাক্যের পর বাক্য। হয়ত দাঁড়িয়েও গেল একটা কিছু, অভাবিতপূর্ব। এরকম কিংবা এর সমগোত্রীয় অনুভূতি কার না-আছে আমাদের, স্ব স্ব ক্ষেত্রে ? এ তবু সটোরি নয় জানি, কারণ এ খণ্ডকালীন। তবে নিরবচ্ছিন্ন কেনশো তথা সটোরি আমাদের কবিদের কেউ কেউ পেয়েছিলেন বলে ধারণা হয় আমার, হয়ত তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হয়ত জীবনানন্দ দাশ, হয়ত বিনয় মজুমদার, হয়ত শক্তি চট্টোপাধ্যায়, হয়ত বা আবুল হাসান-- অথবা হয়ত পেয়েছিলেন উল্লিখিত সকলেই এবং অবশ্যই আরো অনেকে।

তত্ত্বীয় জ্ঞানচর্চা ও ধর্মীয় পুস্তক পাঠকে নিরুৎসাহিত করলেও পরবর্তী সময়ে জেনেরও নিজস্ব সমৃদ্ধ সাহিত্যভাণ্ডার গড়ে ওঠে, যেগুলো জেনচর্চা ও শিক্ষারই অংশ। কোয়ানসমূহ ধ্যানকার্যের অবশ্যউপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পাশাপাশি জেনসাহিত্যকেও সমৃদ্ধি দিয়েছে, যেগুলো সাধারণ্যে জেনগল্প হিসেবে পঠিত ও বলিত। এগুলো চায়ের টেবিলে পরিবারের সদস্যদের সাথে যেমন বলার উপযোগী, তেমনি আড্ডায় বন্ধুদের সাথে, প্লেনে-ট্রেনে-বাসে যেতে সহযাত্রীর সাথে, অফিসে চা খেতে খেতে সহকর্মীর সাথে, শিশুর জন্য বিদ্যালয়সংলগ্ন স্থানে অপেক্ষমাণ সহঅভিভাবকের সাথেও ঠিক মানিয়ে যায়। তাৎপর্যগত দিক থেকে এসব গল্পের বহুবাচনিকতা দারুণভাবে চমকপ্রদ। দশজন শ্রোতা-পাঠক একই গল্পে দশরকম মানে ও ইঙ্গিত খুঁজে পান, যা আর কেবল মিলতে পারে উচ্চাঙ্গের কবিতায়।

জেনগল্পের একটা মৌখিক ঐতিহ্য বরাবরই ছিল বলে ধারণা হয়। সব গল্পই লিখিত রূপে নেই, আছে অংশত। দীর্ঘদিন মানুষের মুখে মুখে ফেরার পর এসব সংগৃহীত ও গ্রন্থিত। যে কারণে গল্পগুলোর একাধিক পাঠভেদও দুর্লক্ষ্য নয়। তাছাড়া জাতকের গল্পগুলোতে বৌদ্ধের জীবনকথার রূপে যেমন অনেক কল্পকাহিনি অন্তর্ভুক্ত হয়ে সাহিত্যে রূপ পরিগ্রহ করেছে, যার মধ্যে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হবারও আগে ভারতবর্ষে মুখে মুখে প্রচলিত গল্প ঢুকে গেছে ; তেমনি জেনগল্পেও ভারতবর্ষে প্রচলিত প্রাচীন গল্পোপাদান খুঁজে পাওয়া বিস্ময়কর কিছু নয়। সবই এখন জেনের আলো মেখে শতকথা গায়ে ধরে নীরব, আমরা যে নীরবতার আওয়াজ শুনে কিছু একটা শোনা হলো বলে তৃপ্ত বোধ করতে পারি।

জেনের যেমন দীর্ঘ ইতিহাস আছে তেমনি আছে সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ঐতিহ্যও। সময়ের দ্বারা এটি পরীক্ষিত এবং উত্তীর্ণ। আজও পৃথিবীজুড়ে শিল্প-সাহিত্যে জেনের প্রবেশ চলমান। কবি, তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক ও মৌন সন্ন্যাসী থমাস মার্টন (১৯১৫-১৯৬৮) তাঁর বন্ধু তেইতারু সুজুকির মতো বিশ্বাস করতেন যে, ‘প্রকৃত সৃজনশীল ও আধ্যাত্মিক সকল অভিজ্ঞতায় অবশ্যই কমবেশি জেনের উপস্থিতি থাকে।’

ইউরোপের অভিব্যক্তিবাদীদাদাবাদী শিল্পান্দোলনের সাথে তত্ত্বীয়ভাবে কোয়ান ও জেনের মিল রয়েছে। ফরাসি পরাবাস্তববাদী কবি-দার্শনিক রেনে দ্যুমাল (১৯০৮-১৯৪৪) সংস্কৃত ও পালি ভাষার বৌদ্ধ টেক্সটের পাশাপাশি তেইতারু সুজুকির টেক্সট অনুবাদ করেছিলেন। ব্রিটিশ-আমেরিকান দার্শনিক এলান ওয়াটস (১৯১৫-১৯৭৩) জেন বৌদ্ধবাদ বিষয়ে গভীর আগ্রহ দেখান। ১৯৫০-এর দিকে তিনি এ বিষয়ে লিখেন এবং বক্তৃতা করেন। ১৯৫৯ সালে দ্য ধরম বামস নামে বিট জেনারেশনের কবি-লেখক জ্যাঁ কেরুয়াক (১৯২২-১৯৬৯)-এর যে উপন্যাসটি বেরোয় তাতে তিনি দেখান, কীভাবে আমেরিকান তরুণদের ছন্নছাড়া জীবনদর্শনে বৌদ্ধবাদ ও জেনবাদ ছাপ ফেলছে।

জেনের ইতিহাস ও জেন সাহিত্য নিয়ে পল রেপস (১৮৯৫-১৯৯০) ও নয়োজেন সেজাকি (১৮৭৬-১৯৫৮)-র সুবিখ্যাত গ্রন্থ জেন ফ্ল্যাশ, জেন বোনস বেরোয় ১৯৯৮ সালে। আর. এইচ. ব্লেইথ (১৮৯৮-১৯৬৪)-এর পাশ্চাত্য সাহিত্যে জেন বিষয়ক বই জেন ইন ইংলিশ লিটারেচারও পাশ্চাত্যে জেনপ্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে। এছাড়াও ব্লেইথ পাঁচ খণ্ডে সম্পাদনা করেন জেন অ্যান্ড জেন ক্লাসিকস, প্রকাশিত হয় ১৯৬০-এ। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ (১৭৭০-১৮৫০), ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) প্রমুখ জগৎবরেণ্য লেখকের সাহিত্যকর্মেও জেনমেজাজ পরিলক্ষিত হয় বলে সমালোচকগণ অভিমত দিয়েছেন।

জেনের সঙ্গে প্রকৃতির কোনো বিরোধ নেই। বরং বলা হয় প্রকৃতিই জেন। জেন আমাদের প্রকৃতির নিকটবর্তী হতে সহায়তা করে। জেন আমাদের শেখায় কী করে যথাযথভাবে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে হয়। অধিকাংশ জেন লেখক, যেমন কবি মাৎসু বাশো (১৬৪৪-১৬৯৪), ঔপন্যাসিক-প্রকৃতিবিদ হেনরি ডেভিড থরেও (১৮১৭-১৮৬২) প্রকৃতিকে সর্বাগ্রে বিবেচনা দিয়েছেন। জেনের নিকটপ্রভাব অথবা দূরপ্রভাবে প্রাচ্যের অনেক চিত্রশিল্পী পাশ্চাত্যের শিল্পীদেরও বহু আগে থেকেই প্রকৃতিকে তাদের শিল্পের বিষয় করেছিলেন।

সাম্প্রতিক অনেক লেখক-চিন্তক জেনের সাথে অন্যান্য অনেক বিষয়ের সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে শিশু প্রতিপালন, শিক্ষাদান ও নেতৃত্ব। জাপানের অধিবাসীদের জীবনের এটি অনেকাংশ জুড়ে বিরাজিত। জাপানি হাইকু কবিতা, নো নাটক, চা-পানপর্ব, ধনুর্বিদ্যা, তরবারিচালনাবিদ্যা, ফুলসজ্জায় জেন অপরিহার্যভাবে যুক্ত। ধনুর্বিদ্যার নান্দনিকতা আলোচনার ছলে মন নিয়ন্ত্রণের কায়দাকানুন ব্যাখ্যা করে ইউজিন হেরিগেল (১৮৮৪-১৯৫৫) কর্তৃক লিখিত বই জেন ইন দ্য আর্ট অব আর্চারি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়তই খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। একজন আমেরিকান জেনাগ্রহী রবার্ট এম. পিরসিগ গুণবাচকতার অধিবিদ্যা ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর জেন অ্যান্ড দ্যা আর্ট অব মোটরসাইকেল মেনটেইনেন্স : এন ইনকুয়ারি ইনটু ভ্যালুজ গ্রন্থে। এটি ছিল ১৯৭৪ সালে সর্বাধিক বিক্রিত বই, যেটি সারা বিশ্বে ৪০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। পর্বতারোহণের সাথেও জেনের সঙ্গত যোগ পরীক্ষিত হয়েছে। এ বিষয়ে ১৯৯২ সালে একইসঙ্গে ব্রিটেন ও অষ্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত নেভিল শূলম্যান লিখিত একটি বই জেন ইন দা আর্ট অব ক্লাইম্বিং মাউন্টেইনস ১৯৯৯ সালে সাহিত্য প্রকাশ থেকে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে মফিদুল হকের অনুবাদে।

ধ্যানের অনুকূলে বলে জেনআচার্য ও ভিক্ষুদের অনেকেই ছবি এঁকেছেন ও কবিতা লিখেছেন। এসব তথ্য ও কাজ নিয়ে একাধিক বই আছে। স্টিফেন আদ্দিসের বই দি আর্ট অব জেন : পেইন্টিংস অ্যান্ড ক্যালিগ্রাফি বাই জাপানিজ মঙ্কস ১৬০০-১৯২৫ এগুলোর একটি। জেন চিত্রশিল্পী ও ক্যালিগ্রাফারদের জীবনী ও অঙ্কিত ছবির ব্যাখ্যাযুক্ত সংগ্রহ এটি। সাথে যুক্ত হয়েছে আচার্য ও ভিক্ষুদের কবিতা।

অনুসন্ধিৎসু পাঠকমাত্রের জানা আছে যে, কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা বাণীশিল্প থেকে কবি-প্রাবন্ধিক-অধ্যাপক বীতশোক ভট্টাচার্যের অনুবাদে ও সম্পাদনায় ‘জেনগল্প’ নামে এপ্রিল ১৯৮৮-তে একটি বই প্রকাশিত হয়, পরে এর একটি বর্ধিত সংস্করণও প্রকাশিত হয় ‘জেনগল্প-জেনকবিতা’ নামে। ১১ পৃষ্ঠার একটি টানটান ভূমিকাসহ প্রায় শ’খানেক গল্প এবং দেখলেই ভালো লাগে হিরণ মিত্রের এরকম কিছু সাদাকালো আঁকিবুকিসহ প্রকাশিত এই বইটি আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করেছিল। গড়পরতা আয়তনের চেয়ে খানিকটা ছোট ও আদুরে-আদুরে চেহারার এই বই পাঠের পর কখনো আমার এমনও মনে হয়েছে, যদি বীতশোক ভট্টাচার্য না-হয়ে আমিই হতাম সেই ব্যক্তি যে জেনগল্পগুলো বাংলাভাষায় অনুবাদ করেছেন, কতই না ভালো হতো! কিন্তু না, আমার আফসোসের কোনোই কারণ নেই দেখলাম। ওয়েবসাইটে সহজেই মিলে গেল এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলোর বাইরেও প্রচুর কোয়ান তথা জেনগল্পের ইংরেজি ভার্সন, যেগুলো বাংলাভাষাভাষীদের নজরে আনা সম্ভব। জেনকে ভালোভাবে জেনে-বুঝে ওঠবার অপেক্ষা না-করেই উত্তেজনাবশত ওরকম কিছু গল্প বাংলায় রূপান্তরের কাজ শুরু হলো। একইসঙ্গে প্রকাশও চলল ব্লগ-মাধ্যমে, প্রথমে জেন সাধু নামে বাঁধ ভাঙার আওয়াজ তথা সামহ্যোয়ারইনে, পরে মুজিব মেহদী নামে সচলায়তনে। কিন্তু তাতে তৃপ্তি হলো না, কারণ এখনো বাংলাভাষাভাষী পাঠকদের গুরুভাগই মুদ্রণ মাধ্যমের পাঠক, সফট মাধ্যমের নয়। ফলে তাদের সাথে শেয়ার করবার আকাঙ্ক্ষা থেকে এর একাংশের ভার অর্পিত হয় ব্যাস সম্পাদক বন্ধুবর রবিউল করিমের কাঁধে। আগ্রহ দেখান আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ময়দানের হাওয়ার প্রকাশক পাঠসূত্র প্রকাশনীর নির্বাহী, বন্ধুবর রাজীব নূরও। যে কারণে জেনসাহিত্য রূপান্তরের বিস্তৃত পরিকল্পনার কিয়দংশ বাস্তবায়িত হবার আগেই গ্রন্থ মোড়কে এই লেখাগুলো পাঠক সংস্পর্শ লাভের সুযোগ পেয়ে গেল। অথচ জেনকে জানা-বোঝা আমার আজো হয়ে উঠল না, সটোরি লাভ তো দূর অস্ত।

বলা বাহুল্য যে, অন্যসব ধর্মদর্শনের মতো জেনও অনেক শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত। জেনের প্রধান পাঁচটি শাখা হলো গুইয়াঙ, লিনজি, কাওদঙ, ইউনমেন ও ফাইয়ান। এই পাঁচটি শাখা থেকে পরে আরো অনেক উপশাখা তৈরি হয়েছে। এগুলোর কোনো-কোনোটি দীর্ঘ চর্চার ভিতর দিয়ে গিয়ে নানা নিয়মেও বদ্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও এই নিয়মে আরোপিত হয়েছে কড়াকড়ি, কোথাও কোথাও যদিও শিথিলবদ্ধ, নমনীয়। শোনা যায়, আজকাল জাপানের কোনো-কোনো জেনমঠও নাকি সিদ্ধার্থ গৌতম ও তাঁর শিষ্যসাবুদের প্রতিকৃতিতে সয়লাব। বিশুদ্ধ জেন খুঁজতে যাওয়া যেহেতু আমাদের অভীষ্ট নয়, সুতরাং এ নিয়ে আমরা নীরব। আমরা আগ্রহী কোয়ানে তথা জেনগল্পে, যা মানুষের জীবনের সারসত্য অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েও কৌতুকপ্রদ, আনন্দদায়ক, মজাদার, হতবুদ্ধিকর, হেঁয়ালিপূর্ণ, এমনকি মনোগ্রাহী রূপ পরিগ্রহ করে আছে। তাই এগুলো কেবলই পর্বতাগ্রভাগে স্থাপিত মঠে ধ্যানস্থ জেনাগ্রহী ভিক্ষুদের গোপনপাঠ নয়, সাধারণ জীবনযাপনকারী মানুষের মুক্তপাঠও। এগুলো একই অঙ্গে বহু মানে ধারণ করে চুপচাপ। বলা তো যায় না, সচেতন পাঠকের মনোসংযোগে এসব লেখা কথা বলে উঠলেও উঠতে পারে। তাঁরা এমনকি নিহিতার্থ তল্লাশে নামতে চাইতে পারেন জাপানি জেনমাস্টার হাকুইন একাকু (১৬৮৫-১৭৬৮)-এর এই বিখ্যাত কোয়ানের, যে, হোয়াট ইজ দা সাউন্ড অব ওয়ান হ্যান্ড ক্লেপিং?
ধানমণ্ডি, জানুয়ারি ২০০৯

সহায়ক গ্রন্থ
  • বৃহৎবঙ্গ প্রথম খণ্ড, ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, দেজ প্রকাশন, ১৯৯৩ (প্রথম প্রকাশ ১৯৩৫)
  • জেনগল্প বীতশোক ভট্টাচার্য, বাণীশিল্প, এপ্রিল ১৯৮৮
  • জেন জীবনদর্শন ও পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা নেভিল শূলম্যান, মফিদুল হক অনূদিত, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৯
  • তাও-তে-চিং : লাও-ৎস কথিত জীবনবাদ অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর অনূদিত, বাঙলা, ২০০১
  • তাও তে চিং, সহজিয়া পথ, লাও ৎস সরকার আমিন অনূদিত, বাংলা একাডেমী, ২০০৮
  • গৌতম বুদ্ধ এবং তার ধর্ম শরদিন্দু শেখর চাকমা, অংকুর প্রকাশনী, ২০০৮
সহায়ক ব্যক্তিবর্গ

হাকুইন একাকু (১৬৮৫-১৭৬৮)-এর দুটো ড্রইং

কৃত্য-বিড়াল

আধ্যাত্মিক গুরু ও তার শিষ্যসাবুদ যখন সান্ধ্য ধ্যানকৃত্য আরম্ভ করতেন, তখন মঠে থাকা বিড়ালটি এমন গোলমাল শুরু করত যে, তা তাদের চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করে দিত। এ কারণে তিনি সান্ধ্যকৃত্যের সময় বিড়ালটিকে আটকে রাখার নির্দেশ দিলেন। একবছর পর, যখন গুরু প্রয়াত হলেন, তখনো ধ্যানকৃত্যে বিড়ালটিকে আটকে রাখা অব্যাহত রইল। শেষাবধি বিড়ালটি মরে গেলে মঠে আরেকটি বিড়াল আনীত হলো এবং যথারীতি সেটিকেও আটকে রাখা হলো। আর শত শত বছর পর ওই আধ্যাত্মিক গুরুর বিজ্ঞ অনুসারীরা ধ্যানকৃত্যে বিড়াল বেঁধে রাখার ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পর্কে রাশি রাশি জ্ঞানপুস্তক প্রণয়ন করলেন।

ঐরাবত ও নীলমাছি

রোশি কাপলিউ একদল মনোবিশ্লেষককে জেন শিখাতে সম্মত হলেন। মনোবিশ্লেষণ শিক্ষালয়ের পরিচালক কর্তৃক দলসদস্যদের সাথে পরিচিত হবার পর রোশি মেঝেতে পাতা একটা গদিতে শান্তভাবে বসে রইলেন। এসময় এক শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে কয়েক ফুট দূরে পাতা আরেকটা গদিতে শিক্ষকের দিকে মুখ করে বসল। ‘জেন কী ?’ ওই শিক্ষার্থী জানতে চাইল। রোশি একটি কলা হাতে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে খেতে শুরু করলেন। ‘এই-ই সব ? এর বাইরে আমাকে আপনার আর কিছুই দেখাবার নেই ?’, শিক্ষার্থী অনুযোগ করল। ‘দয়া করে আরো কাছে আসো’, শিক্ষক বললেন। শিক্ষার্থী তাই করল। রোশি তখন কলার বাকি অংশ শিক্ষার্থীর মুখের সামনে তুলে ধরলেন। শিক্ষার্থী পুনর্প্রণাম করে স্থান ত্যাগ করল।

আরেকজন শিক্ষার্থী উঠে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশে বলল, ‘আপনারা কি সবাই বুঝেছেন ?’ কোনো সাড়া না-পেয়ে ওই শিক্ষার্থী যুক্ত করল, ‘আপনারা জেনের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি উপস্থাপনা প্রত্যক্ষ করলেন মাত্র। আর কারো কি কোনো প্রশ্ন আছে ?’

দীর্ঘ বিরতির পর একজন বলে উঠল, ‘রোশি, আপনার ক্যারিশমায় আমি সন্তুষ্ট নই। আপনি আমাদের সামনে এমন কিছু উপস্থাপন করেছেন, যাতে আমি নিশ্চিত হতে পারি নি যে আমি কিছু বুঝেছি। নিশ্চয়ই আপনার পক্ষে “জেন কী” তা বলা সম্ভব!’

রোশি উত্তর করলেন, ‘আপনারা যদি আমাকে বলতে বাধ্যই করেন, তবে শুনুন। জেন মানে, একটি ঐরাবত একটি নীলমাছিকে লাগাচ্ছে।’

সরাইখানা

এক প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক একদিন এক রাজপ্রাসাদের সদর দরজায় এসে হাজির হলেন। কোনো দ্বাররক্ষকই তাকে থামাবার চেষ্টা করল না। তিনি তার ইচ্ছেমতো ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং সোজা সিংহাসনে আসীন রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

রাজা তৎক্ষণাৎ তাকে চিনতে পেরে বললেন, 'আপনার জন্যে আমি কী করতে পারি ?'

'আমি এই সরাইখানায় খানিক বিশ্রাম নিতে চাই', সাধক বললেন।

রাজা অল্প নাখোশ হলেন এবং বললেন, 'কিন্তু এটা তো কোনো সরাইখানা নয়, এটা আমার প্রাসাদ।'

'আমি কি জানতে চাইতে পারি যে, আপনার আগে এ প্রসাদের মালিকানা কার ছিল ?', সাধকের পালটা প্রশ্ন।

রাজা বললেন, 'আমার পিতার, তিনি ইতোমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন।'

সাধক বললেন, 'এবং তার আগে এটি কার মালিকানায় ছিল ?'

'পিতামহের, তিনিও প্রয়াত হয়েছেন।', রাজা জবাব দিলেন।

'তো, যে স্থানে মানুষ সাময়িককাল থাকেন এবং অতঃপর চলে যান, সে স্থানটি একটি সরাইখানা নয় তো কী ?', বললেন সাধক মহোদয়।

অকেজো জীবন

এক কৃষক দিনে দিনে এমনই বুড়িয়ে যান যে, তিনি মাঠের কাজে যোগ দেবার সক্ষমতা পুরোপুরিই হারিয়ে ফেলেন। তিনি তার সময় কাটাতে থাকেন কেবল বারান্দায় বসে থেকে। তার পুত্র মাঠে কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখে যে বুড়ো বারান্দায় বসে আছেন তো আছেনই। পুত্র নিজে নিজেই ভাবে, 'বুইড়াডা একদম অকেজো অইয়া গেছে, এরে দিয়া আর কোনো কামকাজ অইব না!'

একদিন খুব নিরাশ বোধ করলে কীসব চিন্তাভাবনা করে সুন্দর একটি কাঠের কফিন বানিয়ে আনে পুত্র। কফিনটিকে ঠেলে ঠেলে সে বারান্দা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ওতে তার বাবাকে উঠে বসতে বলে। বিনাবাক্যব্যয়ে বৃদ্ধ কৃষক কফিনে চড়ে বসেন। ঢাকনা লাগিয়ে পুত্র কফিনটিকে ঠেলতে ঠেলতে মাঠের কোণের উঁচু টিলাতে নিয়ে যায়। যখনই সে কফিনটা ছুড়ে দিতে যাবে, অমনি ভিতর দিক থেকে ঢাকনায় মৃদু একটা টোকা অনুভব করে সে। শব্দ শুনে ঢাকনাটা খুলতেই বৃদ্ধ শান্তিপূর্ণভাবে শুয়ে থেকে তার চোখে চোখ রাখেন। 'আমি জানি অহনই তুমি আমারে টিলা থেইক্যা ছুইড়া দিবা, এই কামডা করনের আগে কি আমি তোমারে একটা অনুরোধ করবার পারি ?' 'কী কবা কও', পুত্র জবাব দিল। 'তুমি যদি চাও তাইলে আমারে ছুইড়া দেও, কিন্তুক সুন্দর এই কাডের কফিনডা ভাইঙ্গো না, কারণ তোমার পুলামাইয়ারও জিনিসটা কামে লাগতারে।'

ভূত তাড়ানো

এক ব্যক্তির স্ত্রী দারুণ অসুখে পড়ে। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে সে তার স্বামীকে জানায়, ‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বলে একদমই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না। আমি চাই না যে তুমিও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো। প্রতিজ্ঞা করো, আমি যদি কখনো মারা যাই, তবে তুমি অন্য কোনো মেয়ের দিকেই কখনো তাকাবে না। তা না হলে কিন্তু আমি ভূত হয়ে ফিরে এসে তোমাকে উচিত শিক্ষা দেব।’

স্ত্রীর মৃত্যুর বেশ কয়েক মাস পর পর্যন্ত লোকটি অন্য নারীদের প্রতি উপেক্ষা জিইয়ে রাখল। কিন্তু পরে তার একজনের সাথে দেখা হলো এবং সে রীতিমতো তার প্রেমে পড়ে গেল। এক রাতে তাদের মধ্যে বাগদানও সম্পন্ন হয়ে গেল, যা তার পূর্বতন স্ত্রীর প্রেতাত্মার দৃষ্টিগোচর হলো। প্রতিজ্ঞাভঙ্গের দায়ে প্রেতাত্মা তাকে অভিযুক্ত করল এবং এরপর থেকে প্রতিরাতে ভূত হয়ে এসে তাকে বিদ্রূপ করতে লাগল। কোনো নির্দিষ্ট দিনে তার ও তার বাগদত্তার মধ্যে যা যা ঘটত, প্রেতাত্মা তার সব বলে দিত। এমনকি শব্দ ধরে ধরে সেদিন তারা কী কী কথাবার্তা বলেছে না-বলেছে তা একের পর এক তুলে ধরত। কী লজ্জার কাণ্ড! এ ঘটনায় লোকটির এমন মানসিক বিপর্যয় ঘটে গেল যে, সে এমনকি ঘুমানোর সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলল।

চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে সে নিকটস্থ এক জেনগুরুর কাছে গিয়ে এর প্রতিকার প্রার্থনা করল। লোকটির কাছে আদ্যোপান্ত ঘটনা শুনে জেনগুরু বললেন, ‘এটি খুবই ধূর্ত ভূত’। ‘ঠিকই বলেছেন’, বলল লোকটি। ‘আমি যা বলি ও করি ভূতটি তার সবই নিখুঁতভাবে মনে রাখতে পারে। এটা সবজান্তা ভূত।’ জেনগুরু মুচকি হেসে বললেন, ‘এরকম একটি ভূতের প্রতি তো আপনার উচ্চধারণাই পোষণ করা উচিত। যাহোক, আবার ওটা এলে আপনাকে কী করতে হবে না-হবে তা আমি বলে দিচ্ছি।’

ওইরাতে ভূতটি এলে জেনগুরু তাকে যেরকম উপদেশ দিয়েছেন, লোকটি তার সাথে সেরকম ব্যবহার করল। সে বলল, ‘তুমি একটা অসাধারণ জ্ঞানী ভূত। তুমি জান যে, তোমার কাছে আমি কোনো কিছুই লুকাতে পারি না। তো, তুমি যদি আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পার, তাহলে আজই আমি আমার বাক বা কথা ফিরিয়ে নেব এবং বাকি জীবন একা থাকব।’ ভূত সায় দিয়ে বলল, ‘শুধাও তোমার প্রশ্ন’। লোকটি মেঝেতে রাখা একটা বড়ো ব্যাগ থেকে মুঠোভর্তি করে মটরশুঁটি উঠিয়ে বলল, ‘বল দেখি, আমার হাতে ঠিক কয়টি মটরশুঁটি আছে ?’


ঠিক সেই মুহূর্তেই ভূতটি অদৃশ্য হয়ে যায়, যেটি আর কোনোদিনই ফিরে আসে নি।

একাগ্রতা

ধনুর্বিদ্যায় একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জনের পর এক দাম্ভিক যুবক দক্ষ তীরন্দাজ হিসেবে সর্বজনবিদিত এক জেনগুরুর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। প্রথম চেষ্টায় একটি দূরবর্তী বৃষের চোখে আঘাত করে ও দ্বিতীয়বারে ওই তীর বিযুক্ত করে সে তার বিশেষায়িত কারিগরি দক্ষতা প্রদর্শন করল। ‘ওইখানে’, যুবকটি বৃদ্ধ জেনগুরুকে বলল, ‘দেখুন তো পাল্লা দিতে পারেন কিনা’! গুরু ধনুক উত্তোলন না-করে ধীরস্থিরভাবে ওই তীরন্দাজ যুবকের প্রতি তাকে অনুসরণ করে পর্বতারোহণ করতে আহ্বান জানালেন। বৃদ্ধ পণ্ডিতের অভীষ্টের প্রতি কৌতূহলবশত যুবকটি তাকে অনুসরণ করে ঊর্ধ্বারোহণ করল, যতক্ষণ না তারা একটি গভীর খাদের নিকটবর্তী হলো ; যেটিতে ছিল একটি দুর্বল গাছের গুঁড়ির কম্পমান সেতু। শান্ত পদক্ষেপে ওই টলটলায়মান ও অতি বিপজ্জনক সেতুর মাঝামাঝি গিয়ে বৃদ্ধ একটি দূরবর্তী গাছকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নিয়ে ধনুক উত্তোলন করলেন এবং সমস্যামুক্তভাবে একটি তীর ছুড়লেন। ‘এবার তোমার পালা’, সাবধানে পশ্চাতাবরোহণের পর নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন। আপাতদৃষ্টে ভীতিপ্রদ, সুগভীর ও ইশারারত অতল গহ্বর দেখে ওই যুবক গাছের গুঁড়িতে উঠে কোনো শক্তিই করতে পারল না, যেজন্য তার তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। বৃদ্ধ তার প্রতিযোগীর দুরবস্থা আন্দাজ করলেন এবং বললেন, ‘ধনুর্বিদ্যায় তোমার অনেক দক্ষতা, কিন্তু মন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তোমার অত্যল্প, যেজন্য তুমি ব্যর্থ হলে।’

ঘণ্টাগুরু

নবাগত এক শিক্ষার্থী তার অনুশীলনের জন্য নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করতে হবে তা জেনগুরুর কাছে সবিনয়ে জানতে চাইল। ‘আমাকে একটা ঘণ্টা ভাবো’, গুরু জবাব দিলেন। বললেন, ‘নরম করে টোকা দাও, মৃদু একটা আওয়াজ পাবে। জোরে আঘাত করো, শুনতে পাবে সুতীব্র, আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও নিনাদময় প্রতিধ্বনি।’

জোড়া খরগোশ

এক শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের কাছে প্রস্তাব করল, ‘মার্শাল আর্ট বিষয়ে আমি পারঙ্গমতা অর্জন করতে চাই। এজন্য আপনার কাছে শেখার পাশাপাশি ভিন্ন শৈলী রপ্ত করতে আমি আরেকজন শিক্ষকের কাছ থেকেও পাঠ নেব বলে ঠিক করেছি।’ তারপর সে এ ব্যাপারে শিক্ষকের অভিমত জানতে চাইল।

‘যে শিকারি একসঙ্গে দুটো খরগোশের পশ্চাদ্বাবন করে, সে দুটোর একটিও ধরতে পারে না।’, শিক্ষক জবাব দিলেন।

কল্পনা

একদা মহান তাও গুরু চুয়াং জু স্বপ্ন দেখলেন যে, তিনি প্রজাপতি হয়ে এদিক-সেদিক পাখা ঝাপটাচ্ছেন। ওই স্বপ্নে তার কোনো ব্যক্তিচেতন ছিল না। তিনি ছিলেন কেবলই একটি প্রজাপতি। সহসাই তিনি জেগে উঠলেন এবং দেখলেন তিনি শুয়ে আছেন, যিনি আবারো একজন ব্যক্তি। তখন তিনি ভাবলেন, ‘আমি কি একজন মানুষ ছিলাম যে কল্পনা করছিল একটি প্রজাপতি হয়ে যাওয়া বিষয়ে, নাকি আমি এখন একটি প্রজাপতি যে কল্পনা করে একজন মানুষ হওয়া বিষয়ে ?’

পুস্তকাদি

একদা এক প্রাজ্ঞ দার্শনিক ও পণ্ডিত নিজেকে জেনচর্চায় নিবেদন করলেন। বহু বছর চর্চায় নিবিষ্ট থেকে যেদিন তিনি চূড়ান্তভাবে আলোকদীপ্ত হলেন, সেদিনই তিনি তার সমস্ত পুস্তকাদি আঙিনায় স্তূপীকৃত করলেন ও পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন।

আত্মবাদ

চীন দেশের তাঙ রাজবংশের প্রধানমন্ত্রী তার বাগ্মিতা ও সামরিক নেতৃত্বে সাফল্যের কারণে একজন জাতীয় বীর হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। কিন্তু খ্যাতি, ক্ষমতা ও প্রাচুর্য সত্ত্বেও তিনি নিজেকে খুবই ব্রাত্য জ্ঞান করতেন এবং একজন ধর্মপ্রাণ সাধারণ বৌদ্ধের মতো জীবনযাপন করতেন। প্রায়ই তিনি তার প্রিয় একজন শিক্ষকের কাছে জেন শিখতে যেতেন এবং দুজন খুব ভালো সময় কাটাতেন। সত্যি বলতে কী, তাদের সম্পর্কের ওপরে প্রধানমন্ত্রিত্বের কোনো প্রভাব প্রতীয়মান হতো না, যেজন্য একজনকে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং আরেকজনকে বিনয়ী ছাত্র বলেই মনে হতো।

এরকম এক আড্ডায়, একদিন, প্রধানমন্ত্রী তার শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলেন, ‘মহাত্মন, বৌদ্ধ মতানুযায়ী আত্মবাদ ব্যাপারটা ঠিক কী ?’ শিক্ষকের চোখমুখ মুহূর্তে রক্তবর্ণ ধারণ করল এবং তিনি অত্যন্ত হীনকর ও অপমানজনক স্বরে প্রত্যুত্তর করলেন, ‘এটা কী ধরনের বেয়াদবের মতো প্রশ্ন!’

এই অনাকাঙ্ক্ষিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী খুবই নাখোশ ও ক্রুদ্ধ হলেন। জেনশিক্ষক এরপর মুচকি হাসলেন এবং বললেন, ‘এই হলো, মান্যবর, আত্মবাদ।’

স্রোতের অনুকূলে

একটি তাও গল্পে একবার একজন বৃদ্ধলোক দুর্ঘটনাবশত নদীতে পড়ে যান, তার পতনস্থানটি ছিল অনেক ঊঁচু থেকে বিপজ্জনকভাবে প্রবাহিত একটি প্রস্রবনের উৎসমুখ। প্রত্যক্ষদর্শীরা তার জীবন নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ল। কিন্তু বিস্ময়করভাবেই তিনি প্রবাহের একেবারে শেষবিন্দু থেকে অক্ষতভাবে উঠে এলেন। লোকজন ছুটে এসে তার কাছে জানতে চাইল যে কীভাবে এরকম অবিশ্বাস্য একটি পরিণতি তার ক্ষেত্রে সম্ভব হলো। ‘জল আমার সঙ্গে নয়, বরং আমিই জলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি। ভাবনাচিন্তা না-করে আমি জলের বাঁক-মোচড়ের অনুকূলে মুচড়ে গেছি। ঘূর্ণিতে নিক্ষিপ্ত হয়ে আবার ঘূর্ণির সাথেই বেরিয়ে এসেছি। আমার বেঁচে থাকার রহস্য মোটামুটি এই।’, বৃদ্ধ বিবৃত করলেন।

পবিত্র প্রাজ্ঞজন

পর্বতচূড়ার ছোট্ট কুটিরে বসবাসরত এক প্রাজ্ঞজনের নামে একবার দেশব্যাপী খুব সুনাম ও সুযশ ছড়িয়ে পড়ল। এক গ্রামবাসী সিদ্ধান্ত নিল, সুদীর্ঘ ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে হলেও সে তার সাথে দেখা করবে। সে ওই কুটিরে উপনীত হয়ে এক বৃদ্ধ চাকরকে দেখতে পেল, যে তাকে স্বাগত জানাল। ‘আমি পবিত্র প্রাজ্ঞজনের সাথে দেখা করতে চাই।’ বৃদ্ধ চাকর মৃদু হেসে তাকে কুটিরাভ্যন্তরে নিয়ে গেল। গ্রাম থেকে আগত লোকটি হাঁটার সময় অধীর হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছিল। আকাক্সক্ষা করছিল যে, সে হয়ত সহসাই পবিত্র প্রাজ্ঞজনের মুখোমুখি হবে। কিন্তু তার আগেই সে পেছন দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেল এবং তাকে বাইরে নিষ্ক্রান্ত হবার পথ প্রদর্শন করা হলো। তখন সে থামল ও চাকরের উদ্দেশে বলল, ‘কিন্তু আমি তো পবিত্র প্রাজ্ঞজনের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম।’

‘আপনি তো ইতোমধ্যে দেখা করেছেন’, বৃদ্ধ চাকর বলল। ‘জীবনে আপনার যতজনের সাথেই দেখা হবে, এমনকি যদি তারা দেখতে সাদাসিধে ও তুচ্ছ কেউও হন, প্রত্যেককেই একেকজন পবিত্র প্রাজ্ঞজন হিসেবে দেখুন। এটা করলে যে সমস্যায় পড়ে আপনি এখানে এসেছেন, তা সহজেই সমাধান হয়ে যাবে।’

প্রবুদ্ধ

একদা এক শিক্ষক ঘোষণা দিলেন যে এক তরুণ ভিক্ষু বোধির অগ্রসর স্তরে উপনীত হয়েছেন। এই সংবাদে মঠে যারপরনাই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। ইতঃপূর্বে বোধিপ্রাপ্ত কয়েকজন ভিক্ষু সদ্য বোধিপ্রাপ্ত তরুণ ভিক্ষুর দর্শন লাভ করতে গেলেন। ‘আমরা শুনতে পেলাম আপনি বোধিলাভ করেছেন। কথাটা কি সত্যি ?’ তারা জানতে চাইলেন।

‘সত্যি’, তিনি বললেন।

‘আপনি এখন কেমন অনুভব করছেন ?’

‘চির দুঃখী’, তরুণ ভিক্ষু জবাব দিলেন।

আমি জানি না

এক রাজাধিরাজ, যে কিনা ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ বৌদ্ধ, একবার বৌদ্ধবাদ বিষয়ে প্রশ্ন করতে এক মহান জেনশিক্ষককে প্রাসাদে ডেকে পাঠালেন এবং জানতে চাইলেন, ‘পবিত্র বৌদ্ধ মতাদর্শ অনুযায়ী শিখরতুল্য সত্য কী ?’

‘অসীম শূন্যতা... এবং যার কোথাও কোনো পবিত্রতার চিহ্নমাত্র নেই।’, শিক্ষক জানান দিলেন।

‘যদি কোথাও কোনো পবিত্রতাই না-থাকবে, তাহলে আপনি কে বা কী ?’, রাজাধিরাজ জানতে চাইলেন।

‘আমি জানি না।’, শিক্ষক জবাব দিলেন।

কেটে যাবে

একবার এক শিক্ষার্থী তার ধ্যানশিক্ষকের কাছে গেল এবং বলল, ‘আমার ধ্যানের অবস্থা খুব বাজে! ধ্যানকালে আমি খুব বিক্ষিপ্তচিত্ততা অনুভব করি, অথবা পায়ে লাগাতার ব্যথা করে, অথবা অপরিবর্তনীয়ভাবে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা!’

‘এ অবস্থা থাকবে না, কেটে যাবে’, শিক্ষক নিশ্চিত করে বললেন।

এক সপ্তাহ পরে ওই শিক্ষার্থী আবার তার শিক্ষকের কাছে গেল। বলল, ‘আমার ধ্যানের অবস্থা খুব ভালো! ধ্যানকালে আমি খুব আলোকিত, প্রশান্ত ও সতেজতা বোধ করি! খুবই বিস্ময়কররকম ভালো!

‘এ অবস্থা থাকবে না, কেটে যাবে’, শিক্ষক দৃঢ়ভাবে জানান দিলেন।

মাত্র দুটো শব্দ

একদা এক মঠ ছিল, যেখানকার আচরণবিধি ছিল খুব কঠোর। অঙ্গীকারলব্ধ মৌনব্রত অনুযায়ী ওই মঠে কেউ কোনো কথা বলতে পারত না। তবে এই নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল এই যে, প্রতি দশ বছর অন্তর ভিক্ষুগণ মাত্র দুটো শব্দ উচ্চারণ করতে পারতেন। মঠে প্রথম দশ বছর অতিক্রান্ত হবার পর এক ভিক্ষু প্রধান ভিক্ষুর কাছে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইতোমধ্যে তো দশ বছর অতিক্রান্ত হলো, আপনি কোন শব্দ দুটো বলবার তাড়না বোধ করছেন ?’

‘বিছানা... শক্ত...’, ভিক্ষু বললেন।

‘ও আচ্ছা’, প্রধান ভিক্ষু জবাব দিলেন।

এর দশ বছর পর ওই ভিক্ষু প্রধান ভিক্ষুর কার্যালয়ে হাজির হলেন। ‘আরো দশ বছর তো অতিক্রান্ত হলো। এবার আপনি কোন শব্দ দুটো বলতে আগ্রহী ?’, জানতে চাইলেন প্রধান ভিক্ষু।

‘খাদ্য... বিস্বাদ...’, ভিক্ষু বললেন।

‘ও আচ্ছা’, প্রধান ভিক্ষু জবাব দিলেন।

আরো দশ বছর অতিক্রান্ত হবার পর ওই ভিক্ষু পুনরায় প্রধান ভিক্ষুর সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি জানতে চাইলেন, ‘এই দশ বছর পর আপনার বলবার শব্দ দুটো কী কী ?’

‘আমি... পরিত্যাগী!’ ভিক্ষু বললেন।

‘ঠিকই হয়েছে। আপনার এরকমই হবার কথা।’ প্রধান ভিক্ষু বললেন, ‘আপনি সারা জীবন যা করেছেন তা হলো কেবল অভিযোগ।’

মাছবিজ্ঞ

চুয়াং জু ও তার বন্ধু একদিন নদীর তীর ধরে হাঁটছিলেন। ‘দেখো দেখো, মাছগুলো কেমন সাঁতার কাটছে। সত্যি ওরা নিজেদের মধ্যে খুব আনন্দফুর্তি করছে’, চুয়াং জু বললেন।

‘তুমি কোনো মাছ নও। কাজেই প্রকৃতপক্ষে তুমি জান না যে তারা নিজেদের মধ্যে খুব আনন্দফুর্তি করছে কি না’, বন্ধুটি টিপ্পনী কাটল।

‘তুমি তো আর আমি নও। সুতরাং তুমি কী করে জানো যে মাছেরা নিজেদের মধ্যে আনন্দ করছে কী করছে না এটা আমি জানি না ?’, বললেন চুয়াং জু।

হবেও বা

দীর্ঘদিন ধরে শস্য উৎপাদনের কাজে যুক্ত ছিলেন এমন একজন কৃষককে নিয়ে একটি তাও গল্প আছে। একদিন ওই কৃষকের ঘোড়াটি দূরে কোথাও উধাও হয়ে গেল। এ সংবাদ শুনে তার কয়েকজন প্রতিবেশী ঘটনা দেখতে এল। সহমর্মিতা জানিয়ে তারা বলল, ‘আপনার কী মন্দ কপাল’! কৃষক জবাব দিলেন, ‘হবেও বা’। পরদিন সকালে ঘোড়াটি আরো তিনটি বন্য ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল। এবার প্রতিবেশীরা এসে উত্তেজনা নিয়ে বলল, ‘কী চমৎকার’! বৃদ্ধ কৃষক জবাব দিলেন, ‘হবেও বা’। পরদিন ওই কৃষকের পুত্র একটি অ-বশ্য বন্য ঘোড়ার পিঠে চড়তে গেলে ঘোড়াটি তাকে ফেলে দিল এবং এতে তার একটি পা ভেঙে গেল। প্রতিবেশীরা এ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় আবারো তাদের সহমর্মিতা জানাতে এল। কৃষক এবারও বললেন, ‘হবেও বা’। এর একদিন পর সামরিক বাহিনীর লোকজন তাদের বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে ভর্তির জন্য যুবক ছেলেদের বাছাই করতে এল। তারা ওই যুবকের পা ভাঙা দেখে তাকে উপেক্ষা করে গেল। এবার প্রতিবেশীরা এসে এমন ভালো একটি ব্যাপার ঘটেছে বলে কৃষককে অভিনন্দন জানাল। ‘হবেও বা’, কৃষক জবাব দিলেন।

হাতেকলমে শেখা

একবার এক ঝানু চোরের পুত্র তার বাবাকে ওই পেশার গোপন কলাকৌশল শিখিয়ে দিতে বলল। বৃদ্ধ চোর এতে রাজি হলেন এবং ওই রাতেই পুত্রকে এক বিশাল বাড়িতে চুরি করতে নিয়ে গেলেন। যখন ওই পরিবারের সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন তিনি তার চুরিবিদ্যায় আগ্রহী পুত্রকে কিছু কাপড়চোপড় নেবার কথা বলে দিয়ে খুব গোপনে বস্ত্রাদি সজ্জিত আছে এমন একটা ছোট্ট কামরায় ঢুকিয়ে দিলেন, যে কামরা দূর থেকেই বন্ধ করে দেয়া যায়। ছেলেটি মাত্রই কিছু কাপড় কব্জা করেছে, আর অমনি তাকে ভিতরে রেখেই দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিলেন বুড়ো চোর। এমনকি তিনি ঘরের বাইরে এসে খুব জোরে সদর দরজায় আঘাত করে বাড়ির লোকদের জাগিয়েও দিলেন এবং কেউ দেখে ফেলার আগেই নিজে সটকে পড়লেন। ঘণ্টাখানেক পরে ছেলেটি নোংরা, স্যাঁতসেঁতে ও পরিশ্রান্ত অবস্থায় গৃহে ফিরল। রাগেদুঃখে সে চিৎকার করে বলল, ‘তুমি আমারে ঘরের মধ্যে রাইখ্যা তালা আটকাইয়া দিলা কেন বাজান ? আমি যদি ডরের চোডে আপ্রাণ চেষ্টা না-করতাম, তাইলে কিছুতেই ফইস্কা আইতে পারতাম না। এতে তো আমার সব জানবার-শিখবার শক্তিই মাডে মারা যাইত।’ বুড়ো চোর মুচকি হেসে বললেন, ‘কিন্তুক এর মধ্যে দিয়াই তো তুমি চুরিশিল্পের প্রথম ছবকটা পাইয়া গেলা বাবা।’

শ্রেষ্ঠ কাজ

এক বিজ্ঞ লিপিচিত্রকর এক টুকরো কাগজের উপর কয়েকটির লিপি অঙ্কন করছিলেন। বিশেষভাবে উপলব্ধিসক্ষম তার এক ছাত্র ওই অঙ্কনকর্ম প্রত্যক্ষ করছিল। চিত্রকর কাজটি শেষ করে এনে তার ছাত্রের মতামত জানতে চাইলেন। ছাত্রটি তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিল যে ওটি মোটেই ভালো কিছু হয় নি। শিক্ষক আবারো চেষ্টা করলেন, ছাত্র আবারো অপছন্দ করল। তিনি সতর্কভাবে লিপিগুলো বারবার নতুন করে আঁকলেন, কিন্তু প্রতিবারই ছাত্রটি ওগুলো বাতিল করে দিল। শেষমেষ, ছাত্রটি যখন দূরে অন্য কোনো একটি বিষয়ে মনোযোগী হলো এবং অঙ্কনকর্ম প্রত্যক্ষ করল না, তখন শিক্ষক খুব দ্রুত ওগুলো পুনরায় অঙ্কনের সুযোগ নিলেন। ‘এবার! কেমন হলো ?’, তিনি ছাত্রের মতামত চাইলেন। সে মনোযোগ সরিয়ে এনে কাজগুলোর দিকে তাকাল। ‘এগুলো...? এ তো শ্রেষ্ঠ কাজ!’, ছাত্রটি উত্তেজনার সাথে বলল।

চঞ্চল মন

বাতাসের মধ্যে কম্পমান একটি পতাকা নিয়ে দু’জন মানুষের মধ্যে তর্ক চলছিল। প্রথমজন তর্কের সূত্রপাত করল ‘বাতাস নড়ছে’ বলে। ‘না, পতাকাটি নড়ছে’, দ্বিতীয়জন বলে উঠল। ঘটনাক্রমে একজন জেনগুরু তাদের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। তিনি তাদের কথাবার্তা শুনতে পেলেন এবং তর্কযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করলেন। বললেন, ‘পতাকাও নড়ছে না, বাতাসও না, নড়ছে বস্তুতপক্ষে মন।’

আর প্রশ্ন নয়

কোনো এক সামাজিক অনুষ্ঠানে এক জেনগুরুর সাথে সাক্ষাৎ হলে সেখানে উপস্থিত একজন মনোরোগবিদ তাকে একটা প্রশ্ন করবেন বলে ঠিক করলেন, যে প্রশ্নটি আগে থেকেই তার মনের মধ্যে ছিল। ‘আপনি মানুষকে ঠিক কীভাবে সাহায্য করেন ?’, তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমি তাদের তেমন উচ্চতায় নিয়ে যাই, যেখানে তারা আর কোনো প্রশ্নই করতে পারে না।’, গুরু জবাব দিলেন।

মৃত কেউ নই

একদিন জাপান সম্রাট জেনশিক্ষক নিশিজিমা গুদোকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মৃত্যুর পরে একজন বোধিপ্রাপ্ত মানুষের ক্ষেত্রে কী ঘটে ?’

‘আমি কী করে বলব ?’, গুদো জবাব দিলেন।

‘কারণ আপনি তো একজন শিক্ষক’, সম্রাট বললেন।

গুদো বললেন, ‘তা বটে, কিন্তু মৃত কেউ তো নই!

আত্মনিয়ন্ত্রণ

একবার এক ভূমিকম্প জেনমন্দিরের গোটাটা কাঁপিয়ে দিল। এমনকি মন্দিরের কিয়দংশ ওই ভূকম্পনে ধসেও পড়ল। এতে মন্দিরে থাকা ভিক্ষুদের অনেকেই খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। ভূকম্পন থামলে ভিক্ষুদের উদ্দেশে শিক্ষক বললেন, ‘এখন তোমাদের এটা অনুসন্ধানের একটা সুযোগ এসেছে যে, একজন জেনাগ্রহী সংকট মুহূর্তে ঠিক কীরকম আচরণ করেন। তোমরা হয়ত এতক্ষণে এটাও জেনেছ যে, আমি মোটেও উদ্বিগ্ন ছিলাম না। আমি পরিষ্কার জানতাম যে কী হতে যাচ্ছে এবং আমার করণীয়ই বা কী। আমি যথাসম্ভব দ্রুত তোমাদের সবাইকে হেঁশেলঘরে ঢুকিয়েছি, যেটি এ মন্দিরের সবচেয়ে মজবুত অংশ। সিদ্ধান্তটা ছিল খুবই যথাযথ। কারণ তোমরা জান, কোনো ধরনের হতাহত হওয়া ব্যতিরেকেই আমরা সবাই টিকে গেছি। তবে, আত্মনিয়ন্ত্রিত এবং শান্ত থাকা ছাড়াও আমি অল্পবিস্তর চিন্তিত ছিলাম। আর এটা তোমরা প্রকৃত ঘটনা থেকে বাদও দিতে পার যে, আমি ইয়াবড়ো একগ্লাস জল খেয়েছি, যেরকমটা স্বাভাবিক অবস্থায় আমি কখনো খাই না।’

একজন ভিক্ষু কিছু না-বলে শুধু মুচকি হাসলেন।

‘তুমি হাসছ কেন ?’, শিক্ষক জানতে চাইলেন।

‘ওটা মোটেই জল ছিল না’, ভিক্ষু জবাব দিলেন, ‘গ্লাসটা ছিল সয়া সসের।’

অপমানের পুরস্কার

এক দেশে ছিলেন এক মহান যোদ্ধা। বার্ধক্যপীড়িত হলেও তিনি যেকোনো প্রতিযোগীকে যুদ্ধে হারাতে সক্ষম ছিলেন। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূরদূরান্ত অবধি, ওই ভূমির সর্বত্র। অনেক শিক্ষার্থী তার কাছে ভিড় করতেন যুদ্ধকৌশল শিখবার জন্য।

একদিন ওই গ্রামে এক অখ্যাত তরুণ যোদ্ধার আবির্ভাব ঘটল। সে পণ করল, সেই-ই হবে প্রথম ব্যক্তি যে কিনা ওই বৃদ্ধকে পরাজিত করবে। শক্তি-সামর্থ্যের পাশাপাশি তার ছিল যেকোনো প্রতিপক্ষকে কালিমা দিয়ে স্বার্থোদ্ধার করবার এক ভূতুড়ে ক্ষমতা। সে অপেক্ষা করত প্রতিপক্ষের প্রথম পদক্ষেপের। এরপরই সে বিদ্যুৎগতিতে দুর্বিনীত আক্রমণ চালিয়ে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দিত। প্রথম পদক্ষেপের পর তার সাথে কখনো কোনো যোদ্ধাই আর টিকে থাকতে পারত না।

ওই তরুণ বিষয়ে অবহিত তার ছাত্রদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বৃদ্ধ শিক্ষক হাসিমুখে তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। শুরুতেই তরুণ যোদ্ধা বৃদ্ধ শিক্ষককে প্রবল টিটকারি করতে আরম্ভ করল। সে এমনকি তার মুখে ময়লা ও থুথু পর্যন্ত নিক্ষেপ করল। ঘণ্টাকালব্যাপী ওই তরুণ মানুষের জানাশোনার মধ্যে যতরকম গালি আছে, তা প্রয়োগ করে তাকে অপদস্থ করল। কিন্তু বৃদ্ধ শিক্ষক নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকলেন। ক্রমশ তরুণ যোদ্ধার উদ্যম অবশেষে এসে ঠেকল এবং সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারই হার হয়েছে, এটা বুঝতে পেরে তরুণটি লজ্জায় অধোবদন হয়ে সরে গেল।

নিশ্চয়ই আপত্তিকর কিছু একটা ঘটেছে, যেজন্য তিনি এহেন দুর্বিনীত তরুণের সাথেও যুদ্ধ করলেন না-- এই ভেবে তার সমস্ত ছাত্র তাকে ঘিরে ধরল ও জানতে চাইল, ‘আপনি কীভাবে এত অপমান সহ্য করতে পারলেন ? কীভাবেই-বা আপনি তাকে দূরে ঠেলে দিলেন ?
‘যদি কেউ তোমাকে কোনো উপঢৌকন দিতে আসে এবং তুমি যদি সেটা গ্রহণ না-কর, তাহলে ওই জিনিসের মালিকানা তার নিজেরই হয়-- বৃদ্ধ শিক্ষক জবাব দিলেন।

সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা

এক সুপরিচিত জেনশিক্ষক একদিন জানালেন যে, তার সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হলো ‘তোমার মনটাই বুদ্ধ’। এই নিগূঢ় বাণীতে উচ্ছ্বসিত হয়ে এক ভিক্ষু মঠ ত্যাগ করে নিজের মনকে জাগিয়ে তুলতে ধ্যানেচ্ছায় বিজন উষর প্রান্তরে গমনের সিদ্ধান্ত নিলেন। ওই মহৎ শিক্ষার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সেখানে তিনি সন্ন্যাসী হিসেবে ২০ বছর সময় অতিবাহিত করলেন।

একদিন তিনি বনদেশে ভ্রমণে আসা অন্য এক ভিক্ষুর সাক্ষাৎলাভ করলেন। অচিরেই সন্ন্যাসী ভিক্ষু জানতে পারলেন যে, তিনিও একই শিক্ষকের কাছে জেন শিখেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা বলুন তো আমাদের শিক্ষকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ কোনটি ছিল ?’

প্রশ্ন শুনে পরিব্রাজকের চোখ তৃষ্ণাকাতর হয়ে উঠল। বললেন, ‘এ ব্যাপারে তার চিন্তা তো খুবই স্বচ্ছ ছিল। তার থেকে পাওয়া আমাদের প্রকৃত শিক্ষাটা ছিল, বুদ্ধ আমাদের মনের মধ্যে নেই।’

অকুতোভয়

জাপানের সামন্ত শাসনকালে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল, তখন সহসাই এক দখলদার বাহিনী এক শহরে প্রবেশ করে শহরের নিয়ন্ত্রণভার করায়ত্ত করে নিল। কেবল জেনগুরুকে বাদ দিয়ে ওই শহরের একটি নির্দিষ্ট মহল্লার সব মানুষ সেনাপ্রবেশের পূর্বেই নিরাপদ স্থানে পালিয়ে গেল। বৃদ্ধ জেনগুরুর কেমন বুকের পাটা তা দেখতে জেনারেল স্বয়ং জেনমন্দিরে গিয়ে হাজির হলেন। জেনারেল যেরকমটি দেখে অভ্যস্ত, জেনগুরুর মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর বা বশ্যতার লক্ষণ দেখা গেল না। জেনারেল রাগে ফেটে পড়লেন। মানসিক যে অবস্থায় তিনি তরবারিতে হাত রাখেন, সেরকম ক্রোধে চিৎকার করে বললেন, ‘আপনি একটা আহাম্মক, আপনি কি এটাও উপলব্ধি করেন নি যে যার সামনে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, সে চাইলে চোখের পলকে আপনাকে বিলীন করে দিতে পারে!’ কিন্তু এই হুমকি উপেক্ষা করেও জেনগুরু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। শান্তভাবে বললেন, ‘আপনি কি এটা উপলব্ধি করেছেন যে আপনি যার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সে পলক পড়তে না-পড়তেই নিজে থেকে বিলীন হয়ে যেতে পারে ?’

চলতি মুহূর্ত

এক জাপানি যোদ্ধা তার শত্রু কর্তৃক ধৃত হয়ে জেলে নিক্ষিপ্ত হলেন। ভয়ের চোটে ওই রাতে তিনি কিছুতেই ঘুমাতে পারছিলেন না। তার বারবারই মনে হচ্ছিল যে, আগামীকাল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন শেষে বধ করা হবে।

এ সময় হঠাৎই তার জেনগুরুর একটি উপদেশ মনে পড়ে গেল। তিনি বলতেন, আগামীকালের কোনো প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। ওটা হলো একটা মায়া। চলতি মুহূর্তটাই হলো প্রকৃত বাস্তবতা। কথাগুলোর সংস্পর্শে তার দারুণ প্রশান্তি হলো এবং তিনি ঘুমিয়ে গেলেন।

স্বর্গোদ্যান

মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া দুই পরিব্রাজক ক্রমশ ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় খুবই কাতর হয়ে পড়লেন। হাঁটতে হাঁটতে শেষপর্যন্ত তারা একটি উঁচু দেয়ালের কাছে এসে পৌঁছলেন। শুনতে পেলেন, ওইপার থেকে ঝরনার কলকলানি ও পাখির কলরব ভেসে আসছে। তারা দেখলেন, একটি লসলসে গাছের ডাল দেয়ালের ওপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে আছে। গাছের ফলগুলোকে মনে হলো খুবই সুস্বাদু।

একজন কোনোভাবে দেয়াল টপকে ওইপারে নেমে যেতে সক্ষম হলেন। কিন্তু অন্যজন দেয়াল না-টপকিয়ে হারিয়ে যাওয়া অন্য পরিব্রাজকদের মরুদ্যানের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসতে আবার মরুভূমিতে ফিরে গেলেন।

আলোকদীপ্তি

একদা এক ছাত্র তার শিক্ষককে জিজ্ঞেস করল, ‘গুরুজী, আলোকদীপ্ত কীভাবে হওয়া যায় ?’

শিক্ষক জবাব দিলেন, ‘যখন ক্ষুধা লাগবে খাবে, যখন ক্লান্ত লাগবে ঘুমাবে।’

হত্যা

গাসান একদিন তার অনুসারীদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন : “যারা হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং সকল চেতনপ্রাণের রক্ষণাকাঙ্ক্ষা করেন, তারা সঠিক। এমনকি জীবজন্তু ও কীটপতঙ্গ রক্ষা করাও ভালো কাজ। কিন্তু তাদের বেলায় কী হবে, যারা সময়ের অপচয় করে ও সম্পদের বিনাশ ঘটায় ? এবং তারা, যারা ধ্বংস করে রাজনৈতিক অর্থনীতি ? আমাদের তাদেরকেও ছেড়ে কথা বললে চলবে না। সর্বোপরি, সেরকম একজন, যে আলোকপ্রাপ্ত না-হয়েও ধর্মোপদেশ দেয় ? সে আসলে বুদ্ধবাদকে খুন করছে।”

বাগানে একটি কচ্ছপ

দাইজুর মঠে এক ভিক্ষু একটি কচ্ছপ দেখতে পেয়ে দাইজুকে জিজ্ঞেস করল, 'সকল জীবই তাদের হাড় ঢেকে রাখে মাংস ও ত্বক দিয়ে। কিন্তু এই জীবটি কেন তার মাংস ও ত্বক হাড় দিয়ে ঢেকে রাখে ?' দাইজু তৎক্ষণাৎ তার পা থেকে একটি স্যান্ডেল খুলে নিলেন এবং কচ্ছপটিকে তা দিয়ে ঢেকে দিলেন।

ঈশ্বর খুঁজি



নদীতীরে ধ্যানস্থ অবস্থায় এক নির্জনবাসী সন্ন্যাসীকে এক যুবক প্রস্তাব দেয় যে, 'আমি আপনার শিষ্য হতে চাই' 'কী হেতু ?', সন্ন্যাসী জানতে চানযুবকটি মুহূর্তখানেক ভেবে বলল, '...কারণ আমি ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে চাই'

সন্ন্যাসী লাফ দিয়ে উঠে যুবকটির ঘাড় ধরে এক ধাক্কায় নদীতে ফেলে দেন এবং মাথাটা পানির নিচে চুবিয়ে ধরেনএক মিনিট যেতে না-যেতেই যুবকটি মুক্ত হবার জন্য প্রাণান্ত করতে থাকলে সন্ন্যাসী শেষপর্যন্ত তাকে তীরে উঠিয়ে আনেনযুবকটি কাশতে কাশতে অস্থির হয়ে হাঁপাতে থাকেশেষপর্যন্ত সে শান্ত হলে সন্ন্যাসী জিজ্ঞেস করলেন, 'এক্ষণে বলো, নিমজ্জনকালে সর্বক্ষণ তুমি কী অনুসন্ধান করছিলে ?'

'বাতাস', যুবকটি বলল

সন্ন্যাসী বললেন, 'উত্তম, এক্ষণে গৃহে যাও এবং এইমতো তীব্রভাবে কদাচ ঈশ্বরকে প্রত্যাশা করিলে এইস্থলে প্রত্যাবর্তন করিও'